একাদশ ভূগোল নির্যাস : দ্বিতীয় সেমিস্টার

Concept of Isostasy & Pratt

Concept of Isostasy & Pratt

পরিবর্তন হয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোলের সিলেবাস । নতুন সিলেবাস অনুযায়ী সমগ্র উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোলকে চারটি সেমিস্টারে বিভক্ত করা হয়েছে, যেখানে একাদশ শ্রেণীতে দুটি এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে দুটি সেমিস্টার অন্তর্ভুক্ত । উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোলের নতুন সিলেবাসের ভিত্তিতে ভূগোলের সেমিস্টার ভিত্তিক বিষয়বস্তুকে আলোচনা করার জন্য আমরা একাদশ ভূগোল নির্যাস : দ্বিতীয় সেমিস্টার বিভাগের সূচনা করি । এই বিভাগে এখন আমরা আলোচনা করবো একাদশ শ্রেণীর দ্বিতীয় সেমিস্টারের Physical Geography এর Unit-I এর Geography as a discipline অধ্যায় এর Concept of Isostasy &Pratt সম্পর্কে । তাহলে আর অপেক্ষা না করে চলো আমরা মূল বিষয়ে প্রবেশ করি ➦


Concept of Isostasy & Pratt

Concept of Isostasy & Pratt // সমস্থিতির ধারণা ও প্রাট 

⇦ পূর্ববর্তী অংশ

➲ মুল ধারণা : পৃথিবী পৃষ্ঠের বৈচিত্রময় ভূমিরুপ হল ভূগাঠনিক প্রক্রিয়াগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য । লক্ষ্য করলে দেখাযায় পৃথিবীর মহাদেশ ও মহাসাগরীয় পৃষ্ঠ তল সমভূমি, সূউচ্চ পর্বত ও গভীর খাত প্রভৃতি নানান রুপ বৈচিত্রে বৈচিত্রময় যা সর্বদা ধ্বংস ও সৃষ্টির সুসংহত প্রণালীতে আবদ্ধ । পৃথিবীর কোন স্থানে খাতের সৃষ্টি হলে অন্য কোন স্থানে সুউচ্চ ভূমিরুপের গঠণ অবশ্যম্ভাবী । অর্থাৎ পৃথিবীর বৈচিত্রময় ভূমিরুপগুলি একে অপরের পরিপূরক হিসাবে ভূ-অভ্যন্তরের কোন স্থানে ভরের সমতা রক্ষা করে চলেছে । পৃথিবী পৃষ্ঠে এরকম সমতা রক্ষাকারী জটিল প্রক্রিয়া এবং তৎসম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও তার ব্যাখ্যাই হল সমস্থিতি মতবাদের মুল ধারণা।
➥ বৈশিষ্ট্যঃ সমস্থিতি মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হলঃ i. ভূত্বকের হালকা সিয়াল স্তর ভারী সিমা স্তরের উপর ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। ii. পর্বত, মালভূমি, সমভূমি নিজেদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে অবস্থান করে। iii. ভূত্বকের যে অংশের উচ্চতা ও ঘনত্ব বেশি সেই অংশ তত গভীরে বিস্তৃত থাকে। iv. অ্যাসথেনোস্ফিয়ারের ওপর একটি নির্দিষ্ট গভীরতায় প্রতিপূরণ তল বরাবর ভূত্বকের ভূমিরূপগুলি অবস্থান করে।

➲ সমস্থিতি ধারণার প্রবক্তা : সমস্থিতি ধারণা সম্পর্কে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন সময়ে তাদের ধারণা প্রদান করেছেন, এদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক প্রাট (John Henry Pratt), ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী এইরি (George Biddell Airy), মার্কিন ভূতত্ত্ববিদ ডাটন (Clarence Edward Dutton), ফিনিশ ভূ-পরিগণক@ হেইসকানেন (Weikko Aleksanteri Heiskanen), দুই মার্কিন ভূ-পরিগণক হেফোর্ডবোয়ি (John Fillmore Hayford & William Bowie), আইরিশ ভূতাত্ত্বিক জলি (John Joly), কানাডিয়ান ভূতাত্ত্বিক ড্যালি (Reginald Aldworth Daly), ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক হোমস (Arthur Holmes) প্রমুখ ।
➥ সমস্থিতি সম্পর্কিত প্রথম ধারণাটি আমরা পাই ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক প্রাট এর থেকে । প্রাট সমস্থিতি সম্পর্কিত তার ধারণা “Philosophical Transactions of the Royal Society” নামক জার্নালের 145 তম খণ্ডে 1855 সালের 1 লা জানুয়ারি “The attraction of the Himalaya mountains, and of the elevated regions beyond them, upon the plumb line in India” নামে প্রকাশিত হয় । এই একই সময়ে একই পত্রিকায় ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী এইরির “On the computations of the effect of the attraction of the mountain masses as disturbing the apparent astronomical latitude of stations in geodetic surveys” নামক গবেষণাপত্রটিও প্রকাশিত হয় । এই দুই গবেষণাপত্রে সমস্থিতি সংক্রান্ত প্রাট ও এইরির মতবাদ পাওয়া যায় । ঊনবিংশ শতকের শেষের দশকে সমস্থিতি সংক্রান্ত তৃতীয় ধারণাটি পাওয়া যায় । 1892 সালে “Bulletin of the Philosophical Society” এর Vol – XI এ প্রকাশিত তার “On some of the greater problems of physical geology” প্রবন্ধে ডাটন সমস্থিতি সংক্রান্ত তার ধারণা উত্থাপন করেন ।
➥ বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের দ্বিতীয় ভাগে 1917 সালে “U.S. Coast and Geodetic Survey” নামক জার্নালের 108 সংখ্যক বিশেষ সংখ্যায় “The Effect of Topography and Isostasy Upon the Gravity Field of the Earth” নামক গবেষণাপত্রে হেফোর্ড ও বোয়ি সমস্থিতি সংক্রান্ত তাদের মতবাদ উত্থাপন করেন । বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে, সমস্থিতি সংক্রান্ত দুটি দুটি ধারণা পাওয়া যায়, যার একটি হল জলির ধারণা এবং অপরটি ড্যালির ধারণা । 1925 সালে প্রকাশিত “The Surface-History of the Earth” নামক গ্রন্থে জলি সমস্থিতি সম্পর্কিত তার মতবাদ উত্থাপন করেন । অপরদিকে “Bulletin of the Geological Society of America” নামক জার্নালের 38(1) সংখ্যার 15-46 নম্বর পাতায় 1927 সালে প্রকাশিত “The Changing World of Geography and its Relation to the Development of Geology” নামক গবেষণাপত্রে ড্যালি সমস্থিতি সম্পর্কিত তার ধারণা উপস্থাপন করেন । বিংশ শতকের চতুর্থ দশকের প্রথম ভাগে সমস্থিতি সংক্রান্ত আরো একটি মতবাদ পাওয়া যায়, যার উপস্থাপক ছিলেন হেইসকানেন । 1933 সালে “Bulletin Géodésique” (বর্তমানে “Journal of Geodesy”) এর 38 তম সংখ্যায় 71-97 পাতায় প্রকাশিত “On the Principle of Isostasy and Its Geological Applications” নামক গবেষণাপত্রে হেইসকানেন তার ধারণা উপস্থাপন করেনবিংশ শতকের পঞ্চম দশকের মাঝামাঝি সময়ে সমস্থিতি সংক্রান্ত হোমস এর মতবাদ আমরা পাই । 1944 সালের মে তে প্রকাশিত “Principles Of Physical Geology” নামক গ্রন্থের “The shape and surface relief of the earth” নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে হোমস সমস্থিতি সংক্রান্ত তার ধারণা উপস্থাপন করেন ।

➲ সমস্থিতি ধারণার অগ্রদূত : প্রাট 1855 সালে “Philosophical Transactions of the Royal Society” নামক জার্নালের 145 তম খণ্ডে 1855 সালের 1 লা জানুয়ারি “The attraction of the Himalaya mountains, and of the elevated regions beyond them, upon the plumb line in India” নামে পদার্থের প্রতিপূরণ নিয়মের (Law of compensation) ওপর ভিত্তি করে তার সমস্থিতি ধারণাটি (Hypothesis) উপস্থাপন করেন । পৃথিবীর সমস্থিতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাভিত্তিক এটি প্রথম কোন ধারণা, যা ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক এভারেস্ট (George Everest) এর নেতৃত্বে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্রাঘিমা রেখার কৌণিক দৈর্ঘ্য পরিমাপের অর্থাৎ জরিপ কার্যের ফলাফলের ভিত্তিতে 1847 সালে প্রকাশিত এভারেস্ট এর “An Account of the Measurement of Two Sections of the Meridional Arc of India” নামক গবেষণাপত্র থেকে প্রাপ্ত কিছু ভ্রান্তি সমাধানের জন্য উপস্থাপিত হয় । প্রাট তার গবেষণাপত্রে তার ধারণা পোষণ করেন যে, ‘পৃথিবীর উপরিভাগের বিভিন্ন ঘনত্বের বিভিন্ন উচ্চতার ভূমিরূপগুলি ভূঅভ্যন্তরে কোন একটি নির্দিষ্ট তল বরাবর একই ঘনাঙ্কে অবস্থান করছে’ । প্রাট এই তলকে ‘Level of compensation‘ (প্রতিবিধান তল বা প্রতিপূরণ তল) নামে অভিহিত করেন । প্রাট তার এই গবেষণাপত্রটি যে একটি ধারণা (Hypothesis) তা তিনি উক্ত গবেষণাপত্রের 69. নম্বর অংশে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন । প্রাটের এই প্রতিপূরণ তল ধারণা থেকে ভূপরিমিতি বিদ্যায় (Geodesy) সমস্থিতি ধারণার সূচনা হয়, তাই নিঃসন্দেহে প্রাটকে সমস্থিতি মতবাদের অগ্রদূত (জনক) হিসাবে অভিহিত করা যায়***।
একই জার্নালে একই সময়ে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী এইরি এর সমস্থিতি সম্পর্কিত ধারণা প্রকাশিত হয় । যেখানে প্রাট এর ধারণা থেকে পৃথক ধারণা প্রদান করা হয় । এইরি তার চার পাতার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন যে, ‘লেখকের (প্রাটের) গাণিতিক পদ্ধতি বা গবেষণা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই, গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তকে সহজ ভাষায় বোঝানোর জন্য আমার এই প্রচেষ্টা, । এইরি তার এই প্রচেষ্টায় উল্লেখ করেন যে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠস্থ ভূমিরূপগুলি ভূপৃষ্ঠের উপর যতো উঁচু হয় ভূঅভ্যন্তরে তার দ্বিগুণ প্রোথিত থাকে । অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের ভূমিরূপের ভার ভূঅভ্যন্তরে একটি নির্দিষ্ট তলে না পড়ে বরং একটি অঞ্চল বরাবর পড়ে, যাকে তিনি “Zone of Compensation” (প্রতিপূরন অঞ্চল) নামে অভিহিত করেন । অর্থাৎ প্রাট যেখানে একটি নির্দিষ্ট তল বা রেখার কথা বলেন সেখানে এইরি তল বা রেখার পরিবর্তে অঞ্চলের কথা বলেন । ফলে প্রাট আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য 1859 সালে একই জার্নালে “On the deflection of the plumb-line in India, caused by the attraction of the Himalaya Mountains and of the elevated regions beyond, and its modification by the compensating effect of a deficiency of matter below the mountain mass” নামক গবেষণা প্রবন্ধে বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করে এইরির ধারণার তিনটি বিশেষ অসঙ্গতিকে খুঁজে বের করে তীব্র সমালোচনা করে খারিজ করেন । প্রাট এর এই এই বিশ্লেষণের পর এইরি কিন্তু আর কখনো বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় ফিরে আসেননি । প্রসঙ্গতঃ বলা যায়, প্রাট তার ধারণা সম্পর্কিত প্রথম গবেষণাপত্রটি 1854 সালের 7ই ডিসেম্বর লন্ডনের রয়েল সোসাইটির কাছে প্রেরণ করেন, এর প্রায় এক মাস পর 1855 সালের 25শে জানুয়ারি এইরি তার মতবাদ ভিত্তিক প্রবন্ধটি একই সংস্থাকে প্রেরণ করেন।

➲ সমস্থিতি সম্পর্কিত প্রাট এর ধারণা : 1855 সালে প্রাট এর ধারণা প্রকাশিত হয় । প্রাট এর সমস্থিতি ধারণার মূল বক্তব্য হল পৃথক ঘনত্ব বিশিষ্ট ভূমিরূপগুলি ভূপৃষ্ঠের উপর পৃথক উচ্চতায় অবস্থান করলেও ভূঅভ্যন্তরে একই গভীরতায় সমান চাপ প্রদান করে । কম ঘনত্বযুক্ত ভূমিভাগগুলির উচ্চতা ভূপৃষ্ঠে অধিক উচ্চ হয়, আবার ঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যাস্তানুপাতে এদের উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে ।
প্রাট সমস্থিতি প্রকল্পটি কয়েকটি মূল ধারনার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যথাঃ i. প্রাটের ধারণাটি “বিষম ঘনত্ব ও সম গভীরতা” (varying density with uniform depth) নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। ii. তিনি বলেন ভূত্বকীয় ভূমিরূপগুলির ভর বা ওজন তাদের ব্যাসের সমানুপাতিক এবং ঘনত্ব ভিন্ন। iii. তার মতে উচ্চতা ও ঘনত্বের মধ্যে ব্যতিক্রমী সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, উচ্চ ভূমিরূপের (পর্বত) ঘনত্ব কম এবং নিচু ভূমিরূপের (সমভূমি বা সমুদ্র বক্ষ) ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। iv. তিনি বলেছেন ভূত্বকীয় এককগুলি অসমান ঘনত্ব বিশিষ্ট হলেও তাদের ভর বা ওজনের জন্য প্রায় একই চাপ প্রয়োগ করে। ফলে বিভিন্ন ঘনত্বের ভূমিরূপগুলি একই সমতলে দাঁড়িয়ে থাকবে। v. প্রাট প্রতিপূরণ রেখা (Line of Compensation)-র অবতারণা করেন। অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট রেখা বরাবর স্থলভাগে ঘনত্বের পার্থক্য হলেও তার নীচে ঘনত্ব অপরিবর্তীত থাকে। একে তিনি প্রতিপূরণ রেখা বা প্রতিবিধান তল বলেছেন। এই তলের ওপর সমান চাপ প্রয়োগ করে নিজের ঘনত্ব অনুসারে ভূপৃষ্ঠের ভূমিরূপগুলি বিভিন্ন উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ, পর্বতগুলি বেশি উচ্চতায় এবং সমভূমি বা সমুদ্রবক্ষ কম উচ্চতায় অবস্থান করে।
➥ প্রাট এর সমস্থিতি মডেলের পরীক্ষা ও সীদ্ধান্ত : প্রাট প্রদত্ত্ব ধারণাটিকে সহজে বোঝার জন্য মডেলের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব । পরীক্ষাটি করার জন্য জন্য, i. সমান ব্যাসের বিভিন্ন ঘনত্ব যুক্ত কিন্তু সম ক্ষেত্রফল, ভর ও ওজন বিশিষ্ট কিছু ধাতব দণ্ড নিতে হবে । ii. একটি পারদপূর্ণ পাত্র নিতে হবে ।
➥ পরীক্ষা : আমরা পরীক্ষাটি করার জন্য রুপা, দস্তা, পাইরাইট, এন্টিমনি, লোহা, নিকেল, তামা ও সিসা ইত্যাদি উপাদানের আটটি ধাতু খণ্ড নিলাম, যাদের ঘনত্ব ভিন্ন । এবার ধাতু খণ্ডগুলি পারদপূর্ণ পত্রের মধ্যে রেখে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে সকল ধাতুগুলির ঘনত্ব পৃথক হলেও ক্ষেত্রফল, ভর ও ওজন সমান হওয়ায় ধাতুখণ্ডগুলি পারদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট তল বরাবর সমহারে চাপ দিয়ে তাদের ঘনত্ব অনুসারে বিভিন্ন উচ্চতায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে ধাতু যতো হালকা (পাইরাইট), সেই ধাতু প্রতিপূরণ তলের থেকে ততো বেশি উচ্চতায় অবস্থান করছে, এবং যে ধাতু যতো ভারী সেই ধাতু প্রতিপূরণ তলের থেকে ততো (সিসা) কম উচ্চতায় উত্থিত হয়ে অবস্থান করছে।
পদার্থ বিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি রূপার ঘনত্ব 10.5 গ্রাম/ঘনসেমিঃ, দস্তার ঘনত্ব 7.1 গ্রাম/ঘনসেমিঃ, পাইরাইটের ঘনত্ব 4.8–5 গ্রাম/ঘনসেমিঃ, এন্টিমনির ঘনত্ব 6.7 গ্রাম/ঘনসেমিঃ, লোহার ঘনত্ব 7.8 গ্রাম/ঘনসেমিঃ, নিকেলের ঘনত্ব 8.9 গ্রাম/ঘনসেমিঃ, তামার ঘনত্ব 8.96 গ্রাম/ঘনসেমিঃ এবং সিসার ঘনত্ব 10.66 গ্রাম/ঘনসেমিঃ । অর্থাৎ এই আটটি উপাদানের মধ্যে সবথেকে হালকা হল পাইরাইট এবং সব থেকে ভারী হল সিসা । প্রাট এর ধারণা অনুযায়ী পারদ পূর্ণ পাত্র থেকে সর্বাধিক উচ্চতায় উত্থিত ধাতব দণ্ডটি হবে পাইরাইট দণ্ড এবং সব থেকে কম উত্থিত ধাতবদণ্ডটি হবে সিসা দণ্ড । নিম্নের চিত্র থেকে পরীক্ষাটি সহজেই বোঝা যাবে ।

➥ সিদ্ধান্তঃ উপরিউক্ত পরীক্ষা পরীক্ষার সাথে প্রাটের ধারণাকে মেলালে তা থেকে এই সীদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ভূত্বকের অধিক উচ্চতার ভূমিরূপগুলি কম ঘনত্বযুক্ত পদার্থ দ্বারা গঠিত আবার কম উচ্চতার ভূমিরূপগুলি অধিক ঘনত্বযুক্ত পদার্থ দ্বারা গঠিত । যা থেকে সহজেই বলা যায় কম ঘনত্বযুক্ত পর্বত বেশি উচ্চতায় এবং ভারী বা বেশি ঘনত্বের সমভূমি বা সমুদ্র বক্ষ কম উচ্চতায় একটি প্রতিপূরণ তল বরাবর অবস্থান করছে। এই ভাবে ঘনত্বের পার্থক্যের ভিত্তিতে মহাদেশের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন উচ্চতায় সমতা বজায় রেখে অবস্থান করে এবং এদের গভীরতা সমান হয়, যা প্রাটের মতবাদের মূল আলোচ্য বিষয় ।
প্রসঙ্গতঃ : এই ধরনের পরীক্ষা প্রাট নিজে করেননি । প্রাটের ধারণার ভিত্তিতে বিভিন্ন ঘনত্বের ধাতব দণ্ড নিয়ে সমস্থিতির প্রথম পরীক্ষাটি করেন বোয়ি । উইলিয়াম বোয়ি 1927 সালে প্রকাশিত তার “Isostasy – The Science of the Equilibrium of the Earth’s Crust” নামক গ্রন্থে প্রাট ও এইরির ধারণাকে বোঝার জন্য দুটি পরীক্ষা করেন । প্রাটের ধারণাকে পরীক্ষামূলক উপস্থাপনের জন্য তিনি রূপা, দস্তা, পাইরাইট, এন্টিমনি, লোহা, তামা ও সিসা এই সাতটি ভিন্ন ধাতুর ধাতব দণ্ড নিয়ে অনুরূপ পরীক্ষাটি করেন । একই গ্রন্থে তিনি এইরির ধারণাকে বোঝার জন্য তামার দণ্ড নিয়ে আরো একটি পরীক্ষা করেন ।

➥ প্রাটের সমস্থিতি ধারণার ত্রুটি : প্রাট প্রদত্ত্ব ধারণা থেকে পরবর্তী সময়ে ভূতত্ত্বতে সমস্থিতি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হলেও এবং তার ধারণা ও ধারণার সাপেক্ষে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বেশ কিছুক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক তার ধারণাকে সমালোচনা করেছেন । প্রাটের সমস্থিতি ধারণার কয়েকটি ত্রুটি হলঃ i. সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রতিবিধান তলের গভীরতা কত হতে পারে তা প্রাটের সমস্থিতি তত্ত্বে উল্লেখ নেই।
ii. তিনি যে প্রতিপূরণ তলের কথা বলেছেন তা অসম্পূর্ণ। নবীন ভঙ্গিল পর্বত ভূঅভ্যন্তরে প্রায় 70 কিঃমিঃ এবং মহাসাগরীয় অংশ প্রায় 10-110 কিঃমিঃ পর্যন্ত নিমজ্জিত অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে ভূকম্পীয় তরঙ্গের পরীক্ষা দ্বারা।
iii. তিনি বলেছেন ভূ-ত্বকীয় একক ভূমিরূপের শীর্ষ থেকে পাদবিন্দু পর্যন্ত ঘনত্ব একই কিন্তু বিভিন্ন ভূমিরূপের ঘনত্ব ভিন্ন। এই ধারনা সবক্ষেত্রে সর্বদা সঠিক নয়।
iv. প্রকৃতপক্ষে দুটি কাছাকাছি অবস্থিত স্থানের মধ্যে অভিকর্ষের মানের পার্থক্য থাকায় সেই স্থানদুটির প্রতিবিধান তলের বিরাট পার্থক্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে কি হবে তা তার তত্ত্বে উল্লেখ নেই।
v. যেখানে ক্ষয় বেশি হবে সেখানে ভূত্বক কিছুটা উপরে উঠবে আর যেখানে সঞ্চয় হবে সেখানে ভূত্বক কিছুটা নিচে বসে যাবে, ফলে প্রতিবিধান তলের সমতলতা বিঘ্নিত হবে।

♦️ইবুক : উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস : একাদশ, প্রথম সেমিস্টার

♦️ইবুক : উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল নির্যাস : একাদশ, দ্বিতীয় সেমিস্টার)

➥ প্রাটের সমস্থিতি ধারণার সাফল্য : প্রাট প্রদত্ত্ব ধারণা বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হলেও তার প্রদত্ত্ব ধারণার কয়েকটি সুফলও রয়েছে, যথাঃ i. প্রাট প্রদত্ত্ব ধারণা সমস্থিতি সংক্রান্ত প্রথম কোন ধারণা, যা গাণিতিক ও জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা সমর্থিত এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক দ্বারা উপস্থাপিত সমস্থিতি মতবাদের ভিত্তিপ্রস্তর । ii. প্রাট তার ধারণার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠস্থ ভূমিরূপগুলি যে বিষম ঘনত্বযুক্ত তার ধারণা প্রদান করেন । iii. প্রাট তার ধারণার মাধ্যমে প্রতিপূরন তলের ধারণাকে ভূতাত্ত্বিক মহলে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে তুলে ধরেন । iv. প্রাট প্রদত্ত্ব ধারণা থেকে পরবর্তী সময়ে 1909 সালে হেফোর্ড সমগ্র মার্কিন মুলুক জুড়ে ত্রিভুজিকরণ পরিমাপের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে সক্ষম হন । v. প্রাট প্রদত্ত্ব ধারণা অনুসরণ করে পরবর্তী সময়ে তাদের গবেষণার মাধ্যমে হেফোর্ড ও বোয়ি ভূগর্ভে 100 কিঃমিঃ গভীরতায় প্রতিবিধান তল নির্ণয়ে সমর্থ হন ।

প্রতিবিধান বা প্রতিপূরণ তল (Level of Compensation) : ভূ-অভ্যন্তরে যে তল বরাবর ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন ভূমিরুপের চাপ বা পীড়ন সমান রুপে পড়ে তা প্রতিবিধান তল নামে অভিহিত । এই তল সর্বপ্রথম অনুমান করেন খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের শ্রেষ্ট প্রতিভা লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্জি । প্রাট তার ধারণার মাধ্যমে প্রতিপূরন তলের ধারণাকে ভূতাত্ত্বিক মহলে গবেষণার বিষয়বস্তু হিসাবে তুলে ধরেন ।
➥ বিশেষ তথ্য : i. হেফোর্ড ও বোয়ি, এদের মতে প্রতিপূরন তল ‘Level of compensation’ বা ‘Isostic level‘ যার গভীরতা 100 কিঃমিঃ । ii. প্রতিবিধান তলের ঊর্ধ্বাংশে সমস্থিতির প্রভাব থাকলেও এই তলের নীচে ভূপ্রাকৃতিক সমস্থিতির প্রভাব নেই। iii. ডাটন প্রতিবিধান তলকে “অভিন্ন চাপের স্তর” (Level of Uniform Pressure) নামে অভিহিত করেছেন। iv. জলি প্রতিবিধান তলকে “প্রতিবিধান অঞ্চল” (Zone of compensation) নামে অভিহিত করেছেন। v. আর্থার হোমস প্রতিবিধান তলকে ‘সমান চাপের স্তর‘ (level of equal pressure) নাম দিয়েছেন। vi. এইরির মতে পর্বত, মালভূমি, সমভূমি প্রত্যেকের প্রতিবিধান তল বিভিন্ন কিন্তু প্রাটের মতে পর্বত, মালভূমি, সমভূমি প্রত্যেকে একই প্রতিবিধান তলে অবস্থিত

➥ আঞ্চলিক প্রতিবিধান তল (Regional Compensation Level) : আঞ্চলিক প্রতিবিধান তল হল সমস্থিতি ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা i. ভাসমান অবস্থায় ভূত্বক গুরুমণ্ডলে যে গভীরতায় ভারসাম্য রক্ষা করছে সেই গভীরতা এবং ii. ভূত্বকের পুরুত্ব ও ঘনত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিবিধান গভীরতা নির্দেশ করে । ডাচ ভূতাত্ত্বিক মিনেজ (Felix Andries Vening Meinesz) 1931 সালে প্রকাশিত তার “Une nouvelle mdthode pour la reduction isostatique regionale de l’intensite de la pesanteur” নামক গবেষণাপত্রে এইরির ভাসমান তত্ত্বকে সংশোধন করে “আঞ্চলিক প্রতিবিধান তল” বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন । ভেনিং মিনেজ এর মতে, “পৃথিবীর ভূ-ত্বকীয় অংশগুলি বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী সামগ্রিক ভাবে নীচের অন্তরস্তরের ওপর সমচাপ প্রদান করে নিজেদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে, একে আঞ্চলিক প্রতিবিধান তল বলে”। তিনি 1939 ও 1941 সালে আঞ্চলিক প্রতিবিধান তলকে কেন্দ্র করে তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমস্থিতির স্বাপেক্ষে হ্রাসমান অভিকর্ষমানগুলি নিয়ে একটি টেবিলও প্রস্তুত করেন । ➣ পরবর্তী অংশ


⟽ পূর্ববর্তী পোস্ট : প্রশান্ত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ খাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page