Pushpa the Rule: Black Market of Red Sandalwood
Pushpa the Rule: Black Market of Red Sandalwood
“পুষ্পা: দ্য রুল”, বান্দ্রেদি সুকুমার এর পরিচালনায় অল্লু অর্জুন ও রশ্মিকা মন্দানা অভিনীত দক্ষিণ ভারতীয় চলচিত্র, যেটি 2024 সালের 5ই ডিসেম্বর মুক্তি পেয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে ঝড় তুলেছে । চলচিত্রটি প্রথম সাতদিনে বিশ্বব্যাপী প্রায় 1,032 কোটি টাকা আয় করে । প্রচারের আলোকে থাকা এই চলচিত্রটি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে কৌতুহল, “কী এমন রয়েছে এই চলচিত্রে ?” । এই চলচিত্রের বিষয়বস্তু লাল চন্দনের কালো বাজারীকে আবর্ত করে । যেখানে দেখানো হয়েছে লাল চন্দন কাঠ বিদেশে বেআইনিভাবে পাচার করে পুষ্পা কিভাবে চোরাবাজারের অন্ধকার সাম্রাজ্যে নিজেকে আলোকিত করেছে । লাল চন্দনের কালো বাজারীর এই এই মারকাটারী গল্প দর্শকদের মনে লাল চন্দন সম্পর্কিত যে কৌতূহল জাগিয়েছে তা নিবৃত্তি করার জন্যই ভৌগোলিক প্রবন্ধ হিসাবে “পুষ্পা দ্যা রুল : লাল চন্দনের কালোবাজারী” প্রবন্ধের অবতারণা । প্রসঙ্গতঃ প্রবন্ধ হল নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ভাষা চর্চার তথ্যভিত্তিক উপস্থাপনা । জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি ও ভাষা বোধের দক্ষতার জন্য প্রবন্ধ পাঠ অনিবার্য । সেই উদ্দেশ্যেই Pushpa the Rule : Black Market of Red Sandalwood (“ঝুঁকেগা ন্যাহি শালা”) প্রবন্ধের অবতারণা ।
পুষ্পা দ্যা রুল : লাল চন্দনের কালোবাজারী
➲ লাল চন্দন গাছ টেরোকারপাস স্যান্টালিনাস (Pterocarpus Santalinus) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত উদ্ভিদ, যা মূলতঃ এশিয়ার ক্রান্তীয় অরণ্য অঞ্চলে স্বাভাবিক বিকশিত উদ্ভিদ । দেশগত পরিসংখ্যান অনুসন্ধান করলে দেখা যায় এই উদ্ভিদ সর্বাধিক পরিমাণে (বিশ্বের 70%) রয়েছে ভারতে । এই নিরিখে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া (20%) ও মালয়েশিয়া (5%) । বিশ্বের 70% ভারত লাল চন্দন গাছ ভারতে জন্মালেও তার রমরমা মূলতঃ দক্ষিণ ভারতে । দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যে এই উদ্ভিদ সর্বাধিক পরিমাণে জন্মায় । ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট লাল চন্দন গাছের 45% রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে । কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্যে রয়েছে যথাক্রমে 25% ও 10% । অর্থাৎ পরিসংখ্যানের নিরিখে অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যকে “বিশ্বের লাল চন্দন গাছের আঁতুড়ঘর” হিসাবে অভিহিত করা যায় ।
➲ লাল চন্দন গাছ সাধারণত 10-30° ঢালযুক্ত অর্থাৎ পাহাড়ী বা পার্বত্যাঞ্চলের 300-900 মিঃ উচ্চতায় সুনিষ্কাশিত, বেলে দোআঁশ মাটিতে ভালভাবে বৃদ্ধি পায় । মাটির pH পরিসীমা 6.0-7.5 এই উদ্ভিদ বিকাশের সহায়ক । উদ্ভিদটির মূল মাটির 1.5 মিটার (4.9 ফুট) গভীরতা পর্যন্ত প্রসারিত হয় । উদ্ভিদটির বিকাশে আদর্শ জলবায়ু হলঃ 20-40°C (68-104°F) এর মধ্যে তাপমাত্রা এবং বার্ষিক 500-1,500 মিমি (20-60 ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত । লাল চন্দন আর্দ্র জলবায়ু পছন্দ করে, গড় আপেক্ষিক আর্দ্রতা 60-80% থাকলে উদ্ভিদটির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে । লালচন্দন প্রকৃতিগতভাবে শক্ত কাঠের গাছ । এই গাছের কাঠের রঙ গাঢ় লাল থেকে লালচে বাদামি । উদ্ভিদটি 10 মিঃ (33 ফুট) পর্যন্ত উচ্চতা যুক্ত হয়ে থাকে এবং এর গুঁড়ির ব্যাস হয় 1 মিঃ (3.3 ফুট) পর্যন্ত । উদ্ভিদটির বাকল পুরু, ধূসর এবং আঁশযুক্ত । পাতা 3-5টি পত্রক বিশিষ্ট যৌগিকপত্র । এর ফুল ছোট, হলুদ এবং সুগন্ধিযুক্ত । উদ্ভিদটির ফল শুঁটির মতো, ফলে 1-2 টি বীজ থাকে । উদ্ভিদটির গ্রথন সূক্ষ্ম থেকে মাঝারি প্রকৃতির, ঘনত্ব 0.9-1.2 গ্রাম/ঘনসেমিঃ ।
➲ লাল চন্দন তার সুবর্ণ কাঠ এবং সুগন্ধের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান । জটিল নকশা এবং নিদর্শন খোদাই করে আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য এই উদ্ভিদের কাঠ অত্যন্ত জনপ্রিয় পছন্দ । ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালযয়ের তথ্য অনুযায়ী, লাল চন্দন কাঠের ব্যবহারের মধ্যে 70% ই ব্যবহার হয় দামি আসবাবপত্র নির্মাণের কাজে । আসবাবপত্র ছাড়াও লাল চন্দন শতাব্দী ধরে ঐতিহ্যবাহী ঔষধ, বিশেষ করে আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি ঔষধ প্রস্তুতি যেমন ব্যবহার হয়ে আসছে তেমনি ত্বকের যত্ন, জ্বর ও হজম সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের মতো চিকিৎসাতেও ব্যবহার হয় । লাল চন্দনের 20% ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী ঔষধ প্রস্তুতির জন্য । আসবাবপত্র ও ঔষুধ ছাড়াও লাল চন্দনের অপরিহার্য অনন্য সুগন্ধি তেলও অত্যন্ত মূল্যবান এবং ইহা অ্যারোমাথেরাপি ও সুগন্ধি প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয়। 5% লাল চন্দন সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক রঞ্জক হিসাবে কাপড়, বিশেষ করে সিল্ক এবং তুলো রঙ করতেও ইহা ব্যবহৃত হয়। 3% লাল চন্দন রঞ্জক জন্য ব্যবহৃত হয় । আধুনিক কালে লাল চন্দন তেল প্রসাধনী তথা স্কিনকেয়ার পণ্য, সাবান ও লোশন তৈরিতে; শিথিলকরণ, মানসিক চাপ কমাতে ও ঘুমের মান উন্নত করতে অ্যারোমাথেরাপিতে এবং ত্বকের যত্ন যেমন ব্রণ ও সোরিয়াসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় । লাল চন্দন কাঠের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও পরিলক্ষিত হয় । হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কৃতিতে এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয় । লাল চন্দনকে হিন্দু ধর্মে পবিত্র বলে মনে করা হয় এবং বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। লাল চন্দনের 80% হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় । অন্যদিকে বৌদ্ধ আচার-অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে ধূপকাঠি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এই উদ্ভিদের কাঠ । আফ্রিকান এবং আফ্রো-ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতিতেও এই কাঠ আধ্যাত্মিক এবং ঔষধি বৈশিষ্ট্যের জন্য ব্যবহৃত হয়। অত্যন্ত মূল্যবান এই কাঠ “লোহিত স্বর্ণ” (Red Gold) হিসাবে অভিহিত হয় ।
➲ বিভিন্ন গুণের জন্য লাল চন্দন কাঠের যথেষ্ট বৈশ্বিক চাহিদা পরিলক্ষিত হয় । Trade Regulation Assistance for Flora and Fauna In Commerce (TRAFFIC) এর তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক বাজারে বার্ষিক 10,000-15,000 টন লাল চন্দন কাঠের প্রয়োজন রয়েছে । এই চাহিদার অধিকাংশই সুগন্ধি, প্রসাধনী এবং ঐতিহ্যগত ওষুধ সহ বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত হয় ৷ Compound Annual Growth Rate (CAGR) এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী চন্দন কাঠের বাজারের আকার 2023 সালে 358.3 মিলিয়ন ডলার থেকে 2031 সালের মধ্যে 6.36% হারে 583.1 মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার অনুমান করা হয়েছে । বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে, চন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসা একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ, যার আনুমানিক মূল্য প্রতি বছর 10-15 বিলিয়ন ডলার । ইন্টারপোলের তথ্য অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি বছরে 1,000-2,000 টন লাল চন্দন কাঠ বাজেয়াপ্ত করে থাকে ৷ ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী 2010 থেকে 2019 এর মধ্যে 1,000 টন লাল চন্দন কাঠ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে । ইন্দোনেশিয়ার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী 2015 থেকে 2020 সালের মধ্যে লাল চন্দন পাচারের জন্য 500 জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মালয়েশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী 2015 থেকে 2020 সালের মধ্যে 200 টন লাল চন্দন কাঠ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে মালয়েশিয়ায়।
➲ লাল চন্দন কাঠের চোরাচালানের সাথে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের সহায়তাকারী নির্দিষ্ট রুট এবং পদ্ধতির একটি জটিল নেটওয়ার্ক জড়িত । প্রাথমিকভাবে চোরাচালানকারীগন ভারত-মিয়ানমার-চীন রুট ও ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-ফিলিপাইন-চীন রুট ব্যবহার করে থাকে । অর্থাৎ চোরাচালানকারী রুটের প্রকৃতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় শেষ গন্তব্য চীন । স্বাভাবিকভাবে বলা যায় অবৈধ চন্দন কাঠের গন্তব্যস্থল চীন । ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে অবৈধ লাল চন্দন কাঠ ভারত-মিয়ানমার-চীন রুটে ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে, মূলতঃ ভারতের মণিপুরের মোরে সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে চীনে পাচার করা হয় । অন্যদিকে সুমাত্রা, জাভা এবং বোর্নিও দ্বীপ থেকে প্রাপ্ত অবৈধ লাল চন্দন কাঠ ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-ফিলিপাইন-চীন রুটে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া সীমান্ত দিয়ে পাচার করে প্রথমে ফিলিপাইনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে হংকং বা ম্যাকাও বন্দর দিয়ে চীনে প্রবেশ করানো হয় ।
➲ লাল চন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসার কারণে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক উভয় প্রভাবই লক্ষ্যণীয় । WWF এর তথ্য অনুযায়ী ভারতের 90% লাল চন্দন কাঠের বন অবৈধ ব্যবসার কারণে হারিয়ে গেছে । আবার Mongabay এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর 1.3% হারে ইন্দোনেশিয়ার লাল চন্দন বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে । ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এর তথ্য অনুযায়ী ভারতে 10,000-20,000 লোক লাল চন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসায় নিযুক্ত । অনুমান করা হয় লাল চন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসা ভারতের জিডিপির প্রায় 0.5-1% এর সমান । লাল চন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসার কারণে ভারত প্রতি বছর প্রায় 100 মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা হারায় । “পুষ্পা : দ্যা রাইজ” থেকে “পুষ্পা : দ্যা রুল” এই দুই চলচিত্রে লাল চন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসার এই ভয়ঙ্কর রূপটিই উদঘাটিত হয়েছে ।
➲ লাল চন্দন কাঠের কালো বাজার বা অবৈধ ব্যবসা ভারতীয় অর্থনীতি বা পরিবেশের স্বাপেক্ষে একটি জটিল সমস্যা, যার সমাধানের জন্য সকলের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এর সমাধানের জন্য ভারত সরকার বেশকিছু আইন প্রণয়ন করেছে, যেমনঃ “বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন, 1972” অনুযায়ী লাল চন্দন কাঠকে আইনের দ্বিতীয় তফসিলের অধীনে তালিকাভুক্ত করে এই গাছ কাটা, ব্যবসা এবং রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে । “বন সংরক্ষণ আইন, 1980” অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া লাল চন্দন গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা হয় । এছাড়া লাল চন্দন কাঠের চোরাচালান রোধ করার জন্য 2013 সালে “লাল চন্দন চোরাচালান বিরোধী টাস্ক ফোর্স” গঠন করা হয় । লাল চন্দন চোরাচালান সংক্রান্ত মামলা তদন্ত ও বিচারের জন্য 2015 সালে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (STF) গঠিত হয় এবং ড্রোন ও সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবহার করে ভারত সরকার লাল চন্দন-উৎপাদিত এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে ভারত বিপন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের সংরক্ষণে দায়বদ্ধ । অন্যান্য ক্ষেত্রের সাথে লাল চন্দন কাঠের অবৈধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভারত সরকার Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora (CITES) তে স্বাক্ষরকারী অন্যতম দেশ । আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ এবং সরকারি কার্যাবলীর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের সকলকেই লাল চন্দনের সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে এবং এই দুর্লভ সম্পদকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করতে হবে। ➣ বাংলায় পড়ুন : National Identity Elements India